পৃষ্ঠাসমূহ

১৬ মে, ২০১১

সাপ্তাহিক বুধবার :বৃহস্পতিবার, 12-05-2011

আহম্মদ ফয়েজ ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। নিরীহ মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি নানা ধরনের হয়রানি করছে বলে নানামহল থেকে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি র‌্যাবের এই নির্যাতনের নির্মম শিকার হয়েছে কলেজ ছাত্র লিমন। নির্যাতনের শিকার লিমন একটি পা হারানোর পর গণমাধ্যমসহ নানামহল থেকে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করা হলেও সরকার নির্বিকার। র‌্যাবের কর্মকান্ড দেখে যে কেউই ধরে নিতে পারে এই বাহিনীটি সবধরনের আইনের ঊর্ধ্বে। র‌্যাবের এই হত্যাকান্ডকে বৈধতা দিয়ে ২৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, ‘‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে যে যাই বলুক আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করে যাবে। আত্মরক্ষায় তাদের ছোড়া গুলিতে সন্ত্রাসীদের মরাই স্বাভাবিক।’’ অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিল, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করা হবে।’ ক্ষমতাসীনরা এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অতীতের তুলনায় বেড়েছে এবং এর বেশিরভাগই ঘটছে র‌্যাবের হাতে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাত বছরে এই বাহিনীর হত্যাকান্ডের সংখ্যা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী দাঁড়িয়েছে অন্তত এক হাজারে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাবের হাতে খুন হয়েছে ২০০ জন মানুষ। শুধু গত বছরই র‌্যাবের কথিত ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮০ জন মানুষ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে র‌্যাবের ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন আরো ১২ জন। মানবাধিকার সংগঠনসহ দেশ-বিদেশের নানা মহল র‌্যাবের এই কর্মকান্ডকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে এর বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বেই থেকে যাচ্ছে র‌্যাব।
নিরপরাধ লিমন হয়ে যায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী : এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ দিনমজুরের ছেলে লিমন। সে পরিবারের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন একটি অবস্থার মধ্যে থেকেও পড়াশুনা বন্ধ রাখেনি, কলেজের ক্লাস-পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির পাশের ইট ভাটায় কাজ করে নিজের পড়াশুনার খরচের পাশাপাশি পরিবারকেও সাহায্য করার চেষ্টা করত সর্বক্ষণ। কোনো কারণ ছাড়াই ‘র‌্যাব’ সেই লিমনের পায়ে গুলি করে তাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। লিমন এখন জামিনে মুক্ত। নিরপরাধ হয়েও জামিনে মুক্ত থাকতে হচ্ছে লিমনকে। অপরদিকে,  যে র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের এখনো কিছুই হয়নি। ২৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও সাংবাদিকদের বলেছেন, র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু লিমনের বিষয়টিতে তার কিছুই করার নেই।

২৩ মার্চ বিকালে বরিশাল র‌্যাব ৮-এর ডিএডি লুৎফর রহমানসহ র‌্যাবের একটি দল ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে এসে কলেজ ছাত্র লিমনকে আটক করে। র‌্যাব তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তার চিৎকার শুনে গ্রামের লোকজন ঘটনাস্থলে যায়। এসময় র‌্যাব লিমনের বাম পায়ে গুলি করে। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় লিমনকে র‌্যাব সদস্যরা রাজাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে বরিশাল র‌্যাব ৮-এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সবশেষে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়।

র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) মোখলেছুর রহমান ১১ এপ্রিল বলেছেন, ‘লিমন ঘটনার শিকার।’ তারপরও র‌্যাব বাদী হয়ে অন্যান্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জড়িয়ে লিমনের নামে দুটি মামলা করে ও তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। লিমন বর্তমানে জামিনে মুক্ত। তবে লিমনের পক্ষ থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার কোনো অগ্রগতি নেই।

লিমনকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। প্রধান বিচারপতির কাছে প্রশ্ন রেখে গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন, একজন কিশোরকে কি সরাসরি কারাগারে পাঠানো যায়? এতে কি ১৯৭৪ সালের কিশোর আইনের লঙ্ঘন হয় না? মিজানুর রহমান বলেন, তড়িঘড়ি করে অসুস্থ অবস্থায় লিমনকে ঢাকা থেকে ঝালকাঠিতে স্থানান্তর এবং কারাগারে পাঠানো অস্বাভাবিক। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, একজন দুস্থ, অসহায়, পঙ্গু ও ভঙ্গুর কিশোরকে কি রাতের অাঁধারে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া যায়? চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘মোটামুটি’ সুস্থ বলে কি কোনো শব্দ আছে? হাসপাতালের ছাড়পত্র রোগীর হাতে না দিয়ে কি পুলিশের হাতে দেওয়া যায়? মিজানুর রহমান বলেন, পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালকের পদ কি এতই মোহনীয় যে, একে রক্ষা করার জন্য একজন চিকিৎসাধীন পঙ্গু রোগীকে তড়িঘড়ি করে ছেড়ে দিতে হলো? মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে আরো বলেন, সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের সমান সুযোগের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু লিমনের ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, সে এই সাংবিধানিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লিমনের পক্ষে মানবাধিকার কমিশনের আইনি সহায়তা দেওয়া প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা লিমনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে মানবাধিকার কমিশনকে সাহায্য করবে।’

র‌্যাবের হাতে নির্দোষ মানুষের মৃত্যু : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনীটির হাতে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। র‌্যাবের এই হত্যাকান্ডের শিকারের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের কয়েকটি অনুসন্ধান থেকে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়।

অধিকারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১১ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা মহানগরীর কোতোয়ালি থানাধীন ৪৫/২, প্রসন্ন পোদ্দার লেনের বাসিন্দা মৃত নাসির উদ্দিন আহম্মেদ নেসারের ছেলে মোঃ রাসেল আহম্মেদ ভুট্টোকে (৩৪) জিন্দাবাহার এলাকায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্কের ভেতরে র‌্যাব ১০-এর ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি-৩ (সিপিসি) লালবাগ ক্যাম্পের সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে বলে নিহতের পরিবার অভিযোগ করেছে। রাসেলের পরিবার জানায়, রাসেলকে ৩ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ২০, নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্টার্ন টাওয়ার শপিং পয়েন্টে তার এক বন্ধুর দোকানের সামনে থেকে সাদা পোশাকধারী র‌্যাব সদস্যরা আটক করে নিয়ে যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে উত্তর শাহজাহানপুরের ইসলাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নামের মুদি দোকানের কর্মচারী মোঃ রফিকুল ইসলামকে (৪১) র‌্যাব সদস্যরা আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। রফিকুলের পরিবার জানায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব সদস্যরা তিনটি পিকআপে করে রফিকুলের কাজের জায়গায় আসে এবং রফিকুলকে এলাকার লোকজনের সামনেই ধরে নিয়ে যায়। গত বছরের ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী বাসস্ট্যান্ড থেকে র‌্যাব-১১ সিপিসি-১-এর সদস্যরা মোঃ ফজলুল হক ফজলকে (৪৪) গ্রেফতার করে এবং একই থানার আটি হাউজিং এলাকার আবু মিয়ার খালি প্লটে তিনি নিহত হন। ফজলের পরিবার অভিযোগ করে, ১৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার লামাপাড়া গ্রামের মোঃ ফজলুল হক ফজলকে র‌্যাব-১১ সিপিসি-১-এর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের মৃত মোতালেব মন্ডল ও নুরজাহান বেগমের পুত্র মোঃ সিদ্দিক মন্ডল (৩০) র‌্যাব-৬ ও ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পরিবারের অভিযোগ, সন্ধ্যায় হলিধানী বাজার থেকে পুলিশ সদস্যরা সিদ্দিককে গ্রেফতার করে এবং রাত সাড়ে ১১টার দিকে রামচন্দ্রপুর হাজী ইউসুফের কলাবাগানে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ৮ মে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা গ্রামের সাইদুর রহমান সাঈদকে (২৮) কুষ্টিয়া জেলার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার পুলিশ সদস্যরা উজানগ্রাম বাজার থেকে গ্রেফতার করে। একই দিনে পুলিশ সদস্যরা সাঈদকে চুয়াডাঙ্গা র‌্যাব-৬ ক্যাম্পের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে। ৯ মে গভীর রাতে র‌্যাব ও আলমডাঙ্গা থানার পুলিশ সদস্যরা সাঈদকে খাসকররা ইউনিয়নের পূর্ব খাসকররা গ্রামের শুকুর আলীর পারিবারিক গোরস্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। র‌্যাবের হাতে নিহত এই ব্যক্তিদের কেউই কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নয় বলে অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। তবে র‌্যাব এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পরই র‌্যাব ওই হত্যাকে বন্দুকযুদ্ধ অথবা ক্রসফায়ার বলে একই গল্প বলে আসছে। এর সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধারেরও দাবি করছে র‌্যাব।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৩টি হত্যাকান্ডের প্রমাণ মিলেছে : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক তদন্তে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে র‌্যাব কমপক্ষে ৩টি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত দল সুনির্দিষ্ট ৩টি অভিযোগ তদন্ত করে ৩টি ক্ষেত্রেই একই চিত্র পেয়েছে। গত বছরের জুনে র‌্যাবের গুলিতে তেজগাঁও পলিটেকনিক কলেজের ২ ছাত্র নিহত হয়। পরে  র‌্যাবের পক্ষ থেকে এটিকে ‘এনকাউন্টার’ দাবি করা হয়।  নিহত দু’জনকে সন্ত্রাসী হিসেবেও দাবি করে তারা। কিন্তু ওই দুই ছাত্রের সহপাঠী ও শিক্ষকরা জানিয়েছিল, তারা সন্ত্রাসী নয়, বরং মেধাবী ছাত্র। এমনকি পুলিশও নিহত ওই দু’জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ খুঁজে পায়নি। একইরকমভাবে রাজধানীর রামপুরায় উদীয়মান মডেল ও অভিনেতা কায়সার মাহমুদ বাপ্পী নিহত হওয়ার ঘটনাটিকেও ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে দাবি করে র‌্যাব। বাপ্পীকে তালিকাভুক্ত দাগী সন্ত্রাসী হিসেবেও চিহ্নিত করে র‌্যাব ১-এর সদস্যরা। এরপর নিহত বাপ্পীর পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করেন। পরে কমিশনের পরামর্শে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, বাপ্পী র‌্যাবের সোর্সের ভুলের শিকার।

এই ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, র‌্যাবকে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকতে হবে। তারা একেকটি ক্রসফায়ারের ঘটনার পর যে ধরনের গল্প বলে, এর সব ঘটনার গল্পের ধরন একই রকম। এখন মানুষ এসব গল্প বিশ্বাস করে না। তারা তা অব্যাহত রাখলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। একটি বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা কমতে থাকলে তা কখনো ওই বাহিনীর জন্য ভালো হবে না।

ঝুলে আছে হাইকোর্টের সব রুল : ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর ক্রসফায়ার নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সুয়োমটো রুল জারি করে হাইকোর্ট। র‌্যাবের মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র সচিব ও র‌্যাব ৮-এর অধিনায়ককে রুলের জবাব দিতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় আদালত। রুলের জবাবে ক্রসফায়ারের অভিযোগ অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনী। ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর শুনানি শুরুর কথা ছিল এ রুলের। তবে ওইদিন বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মোঃ ইমদাদুল হক আজাদের হাইকোর্ট বেঞ্চে সময় আবেদন নিয়ে হাজির হন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে ২০১০-এর ৩ জানুয়ারি শুনানি মুলতবি রাখার আবেদন করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। ক্রসফায়ার বন্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশ দিয়ে ওই সময় পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে হাইকোর্ট। অ্যাটর্নি জেনারেল আশ্বস্ত করেছিলেন আর ক্রসফায়ার হবে না।

কিন্তু বার্ষিক অবকাশ শেষে ৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালত খোলার পর দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলাম পুনর্গঠন করেন বেঞ্চ। ভেঙে দেওয়া হয় বিচারপতি আবদুর রহমান ও মোঃ ইমদাদুল হক আজাদের বেঞ্চ। যে কারণে এখন পর্যন্ত এ সুয়োমটো রুলের শুনানি শুরু হতে পারেনি। ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে হাইকোর্টে আরো তিনটি রিট রয়েছে।

২০০৬ সালে জারি করা দুটি রুলের শুনানিও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। ২০০৯ সালেও হাইকোর্ট এ নিয়ে রুল জারি করেছিল।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে প্রথম রিট আবেদনটি দায়ের করা হয় ২০০৬ সালের ২৫ মে। পুলিশের হেফাজতে কথিত ক্রসফায়ারে ইসমাইলের নিহত হওয়া নিয়ে এ রিট দায়ের করা হয়। ক্রসফায়ারে ইসমাইল হত্যার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্ট ওই সময় রুল জারি করেন। বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী ও বিচারপতি জিনাত আরার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই রুল জারি করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট আরো একটি রুল জারি করে হাইকোর্ট। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মামনুন রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই রুল জারি করে। রুলে জানতে চাওয়া হয়েছিল- আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা হবে না। আদালত এ রুলটিও জারি করেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে আরেকটি রিট আবেদন দায়ের করা হয় ২০০৯ সালের ২৯ জুন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী যৌথভাবে রিট আবেদনটি করে। এ আবেদনেও হাইকোর্ট ক্রসফায়ার কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। অপরদিকে, মাদারীপুর সদর উপজেলার লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসী নামে দুই সহোদর ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় সুয়োমোটো রুল জারি করে হাইকোর্ট। রুলে দুই সহোদরকে ক্রসফায়ারে হত্যা কেন অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করা হবে না ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০০৯-এর ১৪ ডিসেম্বর এ রুলের শুনানি শুরুর দিনে অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চাওয়ায় হাইকোর্ট কিছু মন্তব্য করেন। ওইদিন র‌্যাবের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্রসফায়ার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে করা রুল সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল শনিবার ‘সাপ্তাহিক বুধবার’কে বলেন, ‘নানা আইনি জটিলতা থাকে, কখনো আবার জটিলতা তৈরিও করা হয়। এসব জটিলতার কারণে সাধারণ মানুষের কল্যাণে আসে এমন অনেক কিছুই থেমে থাকে। আমাদের ওই রিটের অবস্থাও এমন পরিস্থিতির শিকার।’

মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ : র‌্যাবের হাতে এভাবে মানুষ হত্যার ঘটনায় বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। মার্কিন পররাষ্ট দফতরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও এই ধরনের হত্যাকান্ডের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও আইন সালিশ কেন্দ্রসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন প্রতিনিয়তই এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি ও সরকারকে বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকান্ড বন্ধের বিষয়ে সুপারিশ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে, র‌্যাব হত্যা ও নির্যাতনের ছাড়পত্র নিয়ে কাজ করছে। সন্ত্রাস দমনে গঠিত বিশেষ এ বাহিনীকে বিলুপ্ত করতে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানায় সংগঠনটি। একইসঙ্গে এ বাহিনীর প্রতি সমর্থন তুলে নিতে আহবান জানানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি।

নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত র‌্যাব : ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, নিরীহ লোককে অস্ত্র ও মাদক মামলায় জড়িয়ে হয়রানি, গ্রেফতারবাণিজ্যসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। বিতর্কিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুপ্তহত্যা, অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগও উঠছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভুক্তভোগী মানুষ প্রায়ই সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উত্থাপন করছে। র‌্যাব পরিচয়ে বা তাদের পোশাক পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বিভিন্ন ব্যক্তিকে হুমকি দেয়াসহ নানা অভিযোগও রয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, পুরনো ঢাকার দুই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ৪৫ ভরি স্বর্ণ এবং ১৬ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাব ৩-এর সদস্য পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আজিজুল হক, বিডিআরের হাবিলদার রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর রাজধানীর মতিঝিল থানা পুলিশ রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। র‌্যাব ১০-এর অধিনায়কের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ৬ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন রাজধানীর সূত্রাপুরের মিনারা বেগম। তার ছেলে রাজধানীর ৮১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা সাইজুদ্দিন ওরফে সাজুকে র‌্যাব-১০ সদস্যরা গ্রেফতার করে। এরপর আত্মীয়-স্বজন র‌্যাব কর্মকর্তার কাছে গেলে তিনি সাজুর মুক্তির জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। মিনারা বেগম বলেন, টাকা নিয়েও তার ছেলে সাজুকে ছেড়ে দেয়নি র‌্যাব।

র‌্যাব ৩-এর সহকারী পরিচালক এএসপি শোয়েব আহমেদসহ ৩ র‌্যাব সদস্যকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। কমলাপুরে ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম হিরণকে আটক করে প্রায় ১১ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুরান ঢাকার বংশালে মোটরসাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী বাবুলকে র‌্যাব ১০-এর এক মেজর আটক করে। এ সময় পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই র‌্যাব কর্মকর্তা আটক ব্যবসায়ীকে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বংশালে মোটর পার্টস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। সাতক্ষীরায় চিংড়িঘের ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল ইসলামের বাড়িতে অস্ত্র রেখে তা উদ্ধারের নাটক সাজাতে যায় র‌্যাব। ওই সময় র‌্যাবের ২১ সদস্যকে এলাকার লোকজন ৬ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। পরে স্থানীয় থানা পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে র‌্যাব কর্মকর্তা ভুল স্বীকার করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এরকম আরো অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।

অবশ্য র‌্যাবের বিরুদ্ধে আসা বেশিরভাগ অভিযোগই নানা সময় অস্বীকার করেছে র‌্যাব কর্তৃপক্ষ।

র‌্যাব মহাপরিচালকের বক্তব্য : ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বুধবারকে বলেন, ‘গণমাধ্যম বা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন যেটাকে ক্রসফায়ার বলে আসলে সেটা ক্রসফায়ার নয়। ক্রসফায়ার বলতে কিছু নেই। যেটা হয় সেটা হচ্ছে, ফায়ার একচেঞ্জ। দেখা যায় আর্ম টেরোরিস্টরা যখন গুলি চালায় তখনই র‌্যাব গুলি চালায়।’ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের কথা বলে, আর আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে হয়।’ যেহেতু র‌্যাব এটা বিশেষ বাহিনী, সেহেতু এই বাহিনীর নাম ব্যবহার করে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। সেটার বিষয়ে আমরা দেখছি। র‌্যাবের হাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নির্যাতিত হয় না।’ লিমনের পঙ্গু হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে আসলে পরিস্থিতির ভুল শিকার। এটা আমরা আগে বলেছি, এখনো বলছি।’ র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গে র‌্যাব পরিচালক বলেন, ‘এখন যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো আসলে সত্য নয়। র‌্যাব এমন কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। তবুও যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে আমরা সে ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করি।’